বাংলাদেশের ভোটাররা যখন পোলিং বুথে যান তখন হয়তবা তারা ক্ষনস্থায়ী স্মৃতিশক্তিতে ভোগেন নয়তো বা তাদের সীমিত পছন্দের পরিধির কারনে তারা সঠিকভাবে নির্ধারন করতে পারেন না কোন্ রাজনৈতিক নেতারা তাদের ভাগ্য নির্ধারন করবেন। বিএনপি নেতারা নিশ্চয়ই দেশের মানুষের ক্ষনস্থায়ী স্মৃতিশক্তির উপর সম্পুর্ন নির্ভর করেই তাঁর ভাষণ তৈরি করেন নতুবা তারা কি করে ভাবেন তাঁর বিগত অন্ধকার আমালের অভুতপূর্ব দুঃশাসনের স্মৃতি মানুষ ১৫ বছরে ভুলে যাবে। বিগত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের মানুষ সামরিক, আধাসামরিক এবং ‘গনতান্ত্রিক’ শাসন ব্যবস্থা অবলোকন করেছে, কিন্তু বিএনপির বিগত আমালের কুশাসনের সাথে একমাত্র ’৭১ সালের গনহত্যাকারী পাকিস্তানী দখলদার শাসনের তুলনা করা চলে। তাঁর সে শাসনে যেভাবে রাজনৈতিক প্রতীদন্ধী, তাদের কর্মী বা সমর্থক, ধর্মীয় সংখ্যালুঘু, বাঁশখালীতে একই পরিবারের ১১ জন মানুষকে পুড়িয়ে মারাসহ যেভাবে সারাদেশকে এক মৃতপুরীতে পরিনত করা হয়েছিল তার তুলনা একমাত্র পাকিস্তানী গনহত্যাকারী এবং তাদের এদেশীয় অনুচরদের চরম নৃশংসতার সাথেই তুলনীয়।
২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে নির্যাতন ও মৃত্যু নিয়মিত ঘটনায় পরিনত হয়। সরকারের সমালোচনাকারী, তিনি রাজনীতিবিদ বা বুদ্ধিজীবীদ যেই হোনা কেন, তার উপর নির্যাতনের নিষ্ঠুর কৌশল, যেটা ঔপনিবেশিক শাসনের সময় চালু ছিল সেটা আবার পুনরুজ্জীবিত হয়। পাকিস্তানি আধা-ঔপনিবেশিক শাসনের সময়, যন্ত্রচালিত যন্ত্রের মতো অমানবিক কৌশল যেমন বৈদ্যুতিক শক, অন্ধবিন্দু নির্যাতন, রাজশাহী কারাগারে ইলা মিত্র এবং ঢাকার সেনানিবাসের তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীদের উপর যে ধরণের নির্যাতন করা হয়েছিল সেই একই ধরনের নির্যাতনের আবির্ভাব ঘটে।
তাঁর শাসনের কহিনুর মিঞাদের মতন পুলিশ অফিসারদের কথা কি মানুষ ভুলে গেছে যারা ঠান্ডা মাথায় মানুষকে হত্যা আর নির্যাতন করেছে। জনাব কিবরিয়ার মতন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মানুষটাকে শুধু গ্রেনেড মেরেই হত্যা করা হয়নি, তিনি যেন বেঁচে না উঠেন সে উদ্দ্যেশ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র সুপরিকল্পিতভাবে অবহেলা দেখিয়েছে। ২১ শে আগষ্টের মহাহত্যাযঙ্গ ঘটিয়ে জজ মিঞা নামক এক নিরাপরাধ মানুষকে এ হত্যাযঙ্গের এক মাত্র আসামী করা হয়েছে। দেশের মানুষকে কতটুকু নির্বোধ ভাবলে এধরনের নাটক মঞ্চস্থ করা যায় সেটা ভাবা কঠিন। এমনকি সরকার কর্তৃক গঠিত বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি এই ঘটনায় বিদেশী “শত্রু” দেশটির জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করে। এধরনের বক্তব্যের থেকে হাস্যকর আর কি হতে পারে? এই ধরনের অনেকগুলি ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের রিপোর্ট একই ধরনের, যেখানে সরকারী কর্তৃপক্ষ দৃশ্যত ফৌজদারি তদন্ত এবং বিচারিক তদন্তের সাথে জড়িত ছিল। তাঁর শাসনামলে ফৌজদারি তদন্ত এবং বিচারিক তদন্তের উপর মানুষ সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে ফেলে।
তাঁর ‘সোনার ছেলেরা’২০০১ সালে নির্বাচন বিজয়ের পরবর্তীতে যে হত্যা আর অত্যাচার চালিয়েছিল সৌভাগ্যক্রমে আওয়ামীলীগের নির্যাতিত কর্মীরা তার কিয়দংশ প্রতিশোধও গ্রহন করেনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাদের দলের মহাবিজয়ের পরেও। ২০০২ সালে আওয়ামীলীগ ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটে যে মানাবাধিকার সম্মেলন করেছিল সেটা আহত আর অত্যাচারিতদের এক হাসপাতালে পরিনত হয়েছিল। বাংলাদেশের নিদারুন মানাবাধিকার পরিস্থিতিতে বিশ্ববিবেককে নাড়া দেয়ার প্রচেষ্টায় বিশ্বের অনেক রাজধানীতে আয়োজত হয়েছিল মানাবাধিকার সম্মেলন। এর মধ্যে সম্ভবতঃ সবচেয়ে নিকৃষ্ট হলো তথাকথিত ক্রসফায়ারের নামে ঠান্ডা মাথায় মানুষ হত্যা, যা হলো বিএনপি সরকারের সৃষ্ট এবং এখনো চলছে, যদিও অনেক কম মাত্রায়। এ ধরনের বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডের সমর্থনে একের পর এক বিএনপি মন্ত্রীরা বক্তব্য দিয়েছেন কড়া ভাষায়। তথাকথিত বাংলাভাই নামক দৈত্য সৃষ্টি করা হয়েছে যিনি মানুষ হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছেন। যদিও বর্তমান সরকারের শাসনে মানাবাধিকার পরিস্থিতি কোনভাবেই প্রশংসার অবস্থায় নেই তবুও, খোদা না করুক, বিএনপি সেটাকে যে গহব্বরে নিমজ্জিত করেছিল সেখানে পৌঁছুতে বিগত সরকারকে দুরাচারত্বের সে গহীনে নিমজ্জিত হতে পারেনি।
ব্যক্তিগতভাবে একজন অপেশাদার রাজনৈতিক নিবন্ধকার হিসেবে দেশের বাইরে থেকেও গত দুইদশক যাবৎ মানাবাধিকার, গনতন্ত্র এবং আইনের শাসন নিয়ে দেশের সর্বাধিক পঠিত ইংরেজী দৈনিকে আমি অনিয়মিতভাবে লিখে চলেছি। যারা আমার লেখার সাথে পরিচিত তাদের কাছে এটা প্রতীয়মান হবে যে আমার সবচেয়ে কঠিন কথাগুলো সবসময় সরকার প্রধানের জন্য সংরক্ষিত থাকে সেটা যে দলের সরকারই হোক না কেন। ২০০২ সালে যখন রাজনৈতিক প্রতিদন্ধী এবং ধর্মীয় সংখ্যালুঘুদের উপর আক্রমন, অত্যাচার ও হত্যা এমনেষ্টী ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘ মানাবাধিকার কমিশন এবং বিট্রিশ লর্ড সভা সহ বহু মানাবাধিকার সংস্থাকে আলোড়িত করে, তখনও আমার লেখনীর শক্তি এতটুকুও দূর্বল হয়নি। সে সময়ে কানাডাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার, যিনি আমার ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন, আমাকে পরোক্ষভাবে উপদেশ দিয়েছিলেন, সম্ভাব্য সরকারী প্রতিহিংসা এড়াতে ঐ সময়ে বাংলাদেশে না যেতে। তিনি আমার সাথে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারনে যে চাকুরীচ্যুত হতে পারেন সে আশংকাও আমার কাছে প্রকাশ করেছিলেন, যদিও তিনি, একজন পেশাদার কুটনীতিক, বিএনপি রাজনীতির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। অবশ্য পরে তিনি একটা নিম্নস্তরের রাষ্ট্রদূত পদে কি কারনে বদলী হয়েছিলেন সেটা জানার আগ্রহ আমি প্রকাশ করিনি।
ইউনিভার্সিটি ফ্যাকাল্টিতে আমাদের সেরা প্রতিভা নিয়োগের যুগোপযোগী প্রয়াস চার দলীয় জোটের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে শেষ হয়। একজন প্রার্থী এর যোগ্যতা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্বাসের এক আনুগত্য দ্বারা নির্ধারিত হওয়া শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথমস্থানসহ একাধিক স্বর্ণপদক প্রাপ্ত আমার এক ভাগিনী আমাকে ফোন করে জানতে চাইলো তারেক জিয়ার সাথে আমার পরিচয় আছে কি না। কারন জানতে চাইলে বললো, তারেক জিয়ার অনুমোদন ছাড়া কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী পাওয়া অসম্ভব। সে অবশ্য একটি ফ্যাকাল্টি পদের জন্যও নির্বাচিত হয়নি, যদিও একাধিক শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব ছিল বিভাগে। আমার সম্পূর্ণ নিরঅহংকারী ভাগ্নী, একটি নম্র বিধবার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, এমনকি বাঙ্গালী এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করার জন্য কোন সময়ই ছিল না তার। অবশ্য জোট সরকারের ক্ষমতা শেষ হওয়ার পর থেকেই সে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী পেয়েছে এবং সাফল্যের সাথে অধ্যাপনা করছে। তবুও, বিএনপি প্রধান জনসভায় বক্তব্য দিতে পারেন, ‘আমরা যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জনগণকে নিয়োগ করব, আওয়ামী লীগ বা বিএনপি পরিচয়ে নয়’। আমি যখন তার বক্তৃতা পড়ছিলাম তখন উপরে বর্ণিত ভয়াবহ ঘটনাসমূহ আমার মানসপটে ভেসে উঠছিল। ভাবছিলাম বিএনপি প্রধান স্বভাবতই আমাদের লোকদের ক্ষণস্থায়ী স্মৃতির উপর ভর করেই তাঁর অভিযোগ, অভিশংসন এবং প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তারেক রহমানের বক্তব্য পড়ে ভাবি বাঙ্গালীদের স্মৃতিভ্রম এতটাই প্রবল যে মীরজাফর যদি পলাশীর যুদ্ধের পর অন্তত দশ বছর বেঁচে থাকতেন তাহলে বাংলার মানুষের ভোটেই তিনি নবাব নির্বাচিত হতেন!
লেখকঃ ড. মোজাম্মেল খান, ক্যানাডা প্রবাসী অধ্যাপক